রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০

ছন্দের সহজপাঠ

 বাংলা কবিতার ছন্দ ও ছন্দপতন*

- ©সুদীপ্ত বিশ্বাস



(আজকাল যারা কবিতা লেখেন তাদের অনেকেরই ছন্দ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। ছন্দ না জেনে, ছন্দ না মেনে যা খুশি তাই লেখাটা যতটা সহজ, ছন্দ শিখে কবিতা লেখাটি ততটাই কঠিন। সহজে ছন্দ শিখে নেওয়ার জন্য এই প্রবন্ধটি দেওয়া হল। বাজার চলতি ছন্দের বই থেকে ছন্দ শিখে কবিতা লেখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। শুধু কবিরাই নন, বাংলা অনার্স বা মাস্টার্স-এর এবং সিভিল সার্ভিসের (WBCS/IAS) অপশনাল বাংলার ছাত্র-ছাত্রীরাও সহজে ছন্দ শিখে নিতে পারবেন এই আলোচনাটি থেকে।)


বাংলা কবিতার আধুনিক হয়ে ওঠা ইংরেজি কবিতার হাত ধরেই।ইংরেজি রোমান্টিসিজম, ক্লাসিসিজম,ন্যাচারালিজম,রিয়ালিজম,স্যুরিয়ালিজম,স্ট্রাকচারালিজম,মডার্নিজম,পোস্ট-মডার্নিজম এবং ডি-কন্সট্রাকশান বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে।আধুনিক বাংলার সেরা কবিরা ছিলন আধুনিক ইংরেজি কবিতার সঙ্গে সুপরিচিত। ফলে বাংলা কবিতা বিবর্তিত হয় খুব দ্রুত।কিন্তু যে ইংরেজি কবিতার হাত ধরে বাংলা কবিতার এই উন্নতি,তার কিন্তু ছন্দের এত বিভিন্নতা নেই।পুরানো পয়ার, ত্রিপদী ছাড়াও বাংলা কবিতার মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত এই তিন ছন্দ বাংলা কবিতাকে বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে।সেখানে ইংরেজি কবিতাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে এক আয়েম্বিক পেন্টামিটার নিয়েই।হিন্দি, ওড়িয়া ইত্যাদি ভাষাতেও কবিতা আছে,কিন্তু একমাত্র বাংলা কবিতাই  এত বিভিন্ন সুরেলা ছন্দে ছন্দিত।এর কারণ অবশ্যই বাঙালীর আজন্ম কবিতার প্রতি ভালবাসা।হিন্দিভাষী মানুষেরা স্বীকারও করেন, বাংলাকে এক মিষ্টি, ছন্দিত ভাষা হিসাবে।কিন্তু চোখ নয়, কান।কানের উপরেই নির্ভর করতে হবে ছন্দের জন্য।ছন্দ আসলে গানের মতই শোনার জিনিস।আমি বিশ্বাস করি ছন্দ শেখা মোটেই শক্ত কাজ নয়। মাত্র পাঁচ দশ দিনেই ব্যপারটা শিখে নেওয়া যেতে পারে।ছন্দ শিখতে গেলে সিলেবেল বা দল সম্পর্কে একটু খেয়াল রাখতে হবে। শুধু সিলেবেল গুণেই আপনি দলবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দটা শিখে নিতে পারবেন।আসুন আমরা সিলেবেল গুণি। ‘সিলেবেল’ এই শব্দে কটি সি -লে -বেল আছে?  ৩ টি। অক্ষর যদিও ৪ টি। কারণ, ‘বেল’ শব্দটি আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করি। তাই 'বেল' শব্দে  একটি দল বা সিলেবেল। এবার ধরুন ‘ছন্দ’ শব্দটিকে। সিলেবেল আছে ২ টি। ছন্ এবং দ। বাতাস এ ৩ টি অক্ষর থাকলেও সিলেবেল আছে ২ টি। বা এবং তাস।


এবারে আলোচনার প্রথম বাক্যটাকে ধরুন।‘আমি বিশ্বাস করি ছন্দ শেখা মোটেই শক্ত কাজ নয়।’ এখানে কতগুলো সিলেবেল আছে? আমি তে ২, বিশ্বাস এ- বিষ এবং শ্বাস – ২, করি- ২, ছন্দ- ২, শেখা- ২,  মোটেই-  মো  এবং টেই -২, শক্ত- শক্ ও তো -২, কাজ-১, নয় -১ । মোট  ২+২ +২+২+ ২+২ +২+১+১=১৬ টি সিলেবেল।


এবারে ধরুন ‘ তোমরা যাবে নাইট ক্লাবে পরবে ফাটা জিন্স’ লাইনটিকে। কটি সিলেবেল আছে এখানে?  


তোমরা যাবে- ৪ টি, নাইট ক্লাবে- ৪ টি, পরবে ফাটা- ৪ টি, জিন্স-১ টি।


অর্থাৎ,  বাক্যটিতে  মোট ৪+৪+৪+১ মোট ১৩ টি সিলেবেল আছে।


এবারে সারা  দিন আপনার নিজের খুশি মত যে কোনও শব্দ নিন আর তাতে কটি সিলেবেল আছে তা মনে মনে ভাবুন। কোনও কবিতা লেখার চেষ্টা না করে শুধু শব্দ আর সিলেবেল কাউন্ট করুন।


ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা নাচিয়ে-গাইয়ে  আমরা যা-ই হতে চাই না কেন দরকার হয় নির্দিষ্ট শিক্ষা বা কোর্স ওয়ার্কের। এমন কি সাধারণ রাজমিস্ত্রি হতে গেলেও নিতে হয় শিক্ষা। ব্যতিক্রম একমাত্র কবিতা। কবিতার জন্য প্রথাগত ক্লাসের ব্যবস্থা নেই কোথাও। ফলে যারা কবিতা লেখেন তারা শুধু হাতড়ে মরেন কানাগলির এদিক ওদিক।এখানে নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তোলা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। ছন্দ কবিতার সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ একটি অঙ্গ। সুর যেমন গানের, ছন্দ ও তেমন কবিতার। তাই ছন্দ খুব ভালো করে রপ্ত না করতে পারলে কবিতা উপযুক্ত মানে যেতে পারে না কোনও দিনও। বাংলা ছন্দ শিখে, ছন্দে কবিতা লেখা খুবই শক্ত কাজ।এজন্য দরকার দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও সাধনার।তবে একটু সতর্ক হলেই কিছুটা অন্তত শিখতে পারেন যে কেউ।  


১.স্বরবৃত্ত ছন্দ

---------------


বাংলা কবিতার তিনটি প্রধান ছন্দ।স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত তাদের একটি।


এর আগে দল বা সিলেবল বিষয়ে আলোচনা করেছি।দল বা সিলেবল হল ছন্দের প্রাণ।আর ছন্দে চোখের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় কান।তাই কোনো লাইন দেখতে ছোট বা বড় হলেই সেটা বেমানান নয়, কান যদি বেমানান বলে, তবে সেটাই শুনতে হবে।


দল দুই প্রকার।মুক্তদল আর রুদ্ধদল।স্বরবৃত্ত ছন্দে সব দল সমমাত্রিক। কোনটা মুক্তদল, আর কোনটা রুদ্ধদল? কি করে চিনব?


খুব সহজ।যে দলের শেষে স্বরবর্ণ থাকে সেটাই মুক্তদল।আর যে দলের শেষে ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে সেটা রুদ্ধ দল।


যেমন - 'বাজনা বাজে' বাক্যাংশটিতে বাজ, না, বা,  জে এই চারটি দল আছে।এর মধ্যে প্রথমটি হল রুদ্ধ দল।বাকিগুলো মুক্ত দল।


বাজ্+ না+বা+জে = ১+১+১+১= ৪ মাত্রা।


স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে গেলে কোনটা কোন দল,  সেটাও জানার দরকার নেই।শুধু দলের বা সিলেবেলের ধারনাটুকুই যথেষ্ট একদম ঠিকঠাক ছন্দ মেনে স্বরবৃত্তে লেখার জন্য।


এবারে দেখা যাক কিভাবে লেখা হবে।


কবিতার প্রথম লাইনটাই আপনাকে বলে দেবে কবিতাটা কোন ছন্দে লেখা হবে।কারণ, এটা বলা হয়, first line comes from God!


যদি প্রথম লাইনটা স্বরবৃত্ত ছন্দে আসে তো পুরো কবিতাটা স্বরবৃত্ত ছন্দেই লেখা উচিত।নইলে ভাতের বদলে খিচুড়ি রান্না হয়ে যাবে।


এবারে প্রশ্ন, কী করে বুঝব, প্রথম লাইনটা কোন ছন্দে এসেছে?


এটা একটু শক্ত।তিন ছন্দ সম্পর্ক এ প্রাথমিক ধারণা না থাকলে এটা বের করা শক্ত।


যদি দেখা যায় তিন অক্ষরের শব্দের পাশে তিন অক্ষরের শব্দ এসে বসেছে, তাহলে আন্দাজ করা যেতে পারে কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আসছে।যেমন -' হাজার বছর  ধরে আমি পথ...'  এমনি প্রথম লাইন মনে এলে বুঝতে হবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে।সেখানে নিয়ম হবে বিজোড়ে বিজোড় গাঁথ, জোড়ে গাঁথ জোড়।অর্থাৎ তিনের পাশে তিন, দুই এর পাশে দুই অক্ষরের শব্দ।


যদি দেখা যায় প্রথম লাইনে যুক্তাক্ষর যুক্ত শব্দ এসেছে, বা লাইনটা মধ্যম লয়ের তাহলে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে ধরতে হবে।যেমন, 'ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল' এমন প্রথম লাইন এলে ধরে নিতে হবে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে আসছে।


আর যদি দেখা যায় লাইনটা খুব দ্রুত পড়া যাচ্ছে, ছড়ার মত দোলা আছে, তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে বুঝতে হবে।


আজ শুধু স্বরবৃত্ত ছন্দের আলোচনা করছি।তিন ছন্দের আলোচনা পড়ার পরে এই ব্যপারটা ধরতে পারা সহজ হবে।বাস্তবিক, প্রথম লাইনটা দেখে এই ধরতে পারাটা বেশ শক্ত।এর জন্য দরকার ছন্দের নিয়ম মেনে কবিতা পাঠের সঙ্গে ছন্দ পাঠ।আসলে ছন্দপাঠ খুবই আনন্দদায়ক।ছন্দপাঠ করতে শেখা কবি হবার জন্য জরুরি। এমনকি গদ্য কবিতা লেখার জন্যেও।গোটা সংস্কৃত সাহিত্য গদ্যে লেখা, কোথাও অন্তমিল নেই, কিন্তু কি স্পন্দন!  কি স্পন্দন!অন্তমিল অনেক সময় কবিতার ভাবকে দুর্বল করে, কিন্তু ছন্দের স্পন্দন হল কবিতার প্রাণ। তাই ছন্দকে ছুঁড়ে ফেলা শক্ত।বরং ছন্দকে ছুঁয়েই লিখতে হবে কবিতা।


ছড়ার ছন্দ স্বরবৃত্ত চলে চার মাত্রার ছোট ছোট চালে।ঘোড়ার মত টগবগিয়ে ছুটতে থাকে এই ছন্দ। শ্বাসাঘাত প্রধান এই ছন্দ নৃত্যচপল ছন্দস্পন্দনে স্পন্দিত।এই কবিতার দলে স্বরবর্ণের বিশেষ করে ই বা এ কারের প্রাধান্য দেখা যায়।


যেমন:-


'টগবগিয়ে /টগবগিয়ে /ছন্দ চলে /ছুটে'... এমনি একটা লাইন লেখা যেতে পারে।এখানে দেখা যাচ্ছে ৪/৪/৪/২ মাত্রার লাইনটা।কিভাবে?টগ, ব, গি, য়ে এই হল চারটি দল।স্বরবৃত্ত ছন্দে যত দল, তত মাত্রা।তাই টগবগিয়ে চার মাত্রা পাবে।


এবারে আমাদের দ্বিতীয় লাইন লিখতে হবে।আমরা লিখতে পারি, টগবগানো/ শব্দে খোকার /ঘুমটা গেল /টুটে।


এটাও ৪/৪/৪/২ এ আছে।


টগ্+ব+গা+নো = ১+১+১+১= ৪ মাত্রা।


শব্ +দে+ খো+ কার= ১+১+১+১= ৪ মাত্রা


ঘুম+টা+ গে+ল=১+১+১+১=৪মাত্রা


টু+টে = ১+১= ২ মাত্রা।


তাহলে কবিতাটা ঠিকঠাক এগোচ্ছে।এভাবে লাইনের পরে লাইন জুড়ে আমরা সঠিক স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখে যেতে পারব।এই ছন্দ ৪/৪/৪/২ বা ৪/৪/৪/১ এ ভাল লেখা যায়।৪/৪ এও লেখা যায়,তবে তাতে ছন্দের দ্রুততা আরো বেড়ে যায়।যেমন,  পালকি চলে/ দুলকি চালে/ ছয় বেহারা/ জোয়ান তারা। ৪/৪/৪/৪ এখানে লাইনগুলো একটা আর একটার ঘাড়ে এসে পড়ছে। কিন্তু শেষে ওই ১/২ এর ভাঙ্গা মাত্রাটি থাকলে লয়ের দ্রুততা একটু কমে।কবিতাটি সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।


স্বরবৃত্ত এমনিতেই দ্রুত লয়ের ছন্দ।টগবগ টগবগ করতে করতে চলে।সাধারণত ছড়ার ছন্দ হলেও সিরিয়াস কবিতাও লেখা যায় এই ছন্দে।তবে গুরুগম্ভীর কবিতার ছন্দ হল অক্ষরবৃত্ত,স্বরবৃত্ত নয়।


এবারে আরও একটা কবিতা দেখা যাক এই ছন্দে।


তোমরা যাবে নাইট ক্লাবে পরবে ফাটা জিন্স,


আমার ছেলে রিক্সা-পুলার, তোমার ছেলে প্রিন্স।


তোমরা হলে ধূর্ত শেয়াল, আমরা হলাম ফেউ


তোমরা যাবে ডিপ-সী-ট্যুরে, আমরা গুনি ঢেউ।


তোমরা কর পেপার-ওয়ার্ক, আমরা করি কাজ,


পুড়ছি রোদে, ভিজছি জলে, পড়ছে মাথায় বাজ।


তোমরা চাপ এ. সি. গাড়ি, আমরা ধরি ট্রেন


আসতে যেতে চেপ্টে-চিড়ে, হস্তে হেরিকেন ।


তোমারা হলে রাঘব-বোয়াল, তোমরা বানাও জোট


আমরা মশাই খেটেই মরি দিই তোমাদের ভোট ।


তোমরা পর হিরের চুড়ি, আমরা বানাই ঘট


বাড়ছে তোমার টাকার পাহাড় আমরা তো হ্যাভ-নট।


এবারে বোঝাই যাচ্ছে কবিতাটা ৪/৪/৪/১ মাত্রায় লেখা স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা।কারণ, লয় দ্রুত।জীবনানন্দ দাসের 'আবার আসিব ফিরে'র মত মন্থর তান নেই এতে।বরং ছটফটান ভাব আছে।এটাই স্বরবৃত্ত চেনার উপায়।আর তার পরেই ওই ৪/৪/৪/১ বা ২  দল কে খুঁজতে হবে।পেয়ে গেলেই বাজিমাত। কনফার্ম স্বরবৃত্ত। মাত্রা গোনা খুব সহজ এই ছন্দে।যত দল, তত মাত্রা।একমাত্র ব্যতিক্রম তিনটি রুদ্ধদল পাশাপাশি থাকলে তখন চার মাত্রা ধরা হয়।


ছন্দ বিশ্লেষণ :-


তোমরা যাবে /নাইট ক্লাবে/ পরবে ফাটা /জিন্স,৪/৪/৪/১


আমার ছেলে /রিক্সাপুলার /তোমার ছেলে /প্রিন্স।৪/৪/৪/১


তোমরা হলে /ধূর্ত শেয়াল,/ আমরা হলাম /ফেউ ৪/৪/৪/১


তোমরা যাবে /ডিপ-সী-ট্যুরে, /আমরা গুনি/ ঢেউ।৪/৪/৪/১


তোমরা কর/ পেপার-ওয়ার্ক,/ আমরা করি /কাজ,৪/৪/৪/১


পুড়ছি রোদে, /ভিজছি জলে,/ পড়ছে মাথায় /বাজ।৪/৪/৪/১


তোমরা চাপ /এ. সি. গাড়ি,/ আমরা ধরি /ট্রেন ৪/৪/৪/১


আসতে যেতে /চেপ্টে-চিড়ে, /হস্তে হেরি/কেন ।৪/৪/৪/১


তোমারা হলে /রাঘব-বোয়াল, /তোমরা বানাও /জোট ৪/৪/৪/১


আমরা মশাই /খেটেই মরি/ দিই তোমাদের /ভোট ।৪/৪/৪/১


তোমরা পর/ হিরের চুড়ি/ আমরা বানাই/ ঘট ৪/৪/৪/১


বাড়ছে তোমার/ টাকার পাহাড় /আমরা তো হ্যাভ-/নট।৪/৪/৪/১


সব ক্ষেত্রেই কিন্তু যতগুলো সিলেবেল বা দল আছে তত মাত্রা হয়েছে।দল বা সিলেবেল হল এই ছন্দের প্রাণ।আরও একটু ভেঙ্গে দেখাচ্ছি :-


আসতে যেতে /চেপ্টে-চিড়ে, /হস্তে হেরি/কেন ৪/৪/৪/১


আস+ তে+ যে+তে = ৪ মাত্রা


চেপ+টে + চি+ড়ে= ৪ মাত্রা


হস+তে+ হে + রি= ৪ মাত্রা


কেন্=১ মাত্রা।


এভাবে কবিতাটি পড়তে হবে।কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে চলবে ছন্দপাঠ।


আর একটি কবিতা দেখা যাক।


যখন বৃষ্টি নামলো,  কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা।


বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা


দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা।


হয়তো মেঘে- বৃষ্টিতে বা শিউলি গাছের তলে


আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে


কিন্তু তুমি নেই বাহিরে-- অন্তরে মেঘ করে


ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!


ছন্দ বিশ্লেষণ :-


বৃষ্টি নামলো /যখন আমি /উঠোন-পানে /একা ৪/৪/৪/২


দৌড়ে গিয়ে /ভেবেছিলাম /তোমার পাব /দেখা।৪/৪/৪/২


হয়তো মেঘে- /বৃষ্টিতে বা/ শিউলি গাছের /তলে ৪/৪/৪/২


আজানুকেশ/ ভিজিয়ে নিচ্ছো /আকাশ-ছেঁচা/ জলে ৪/৫/৪/২


কিন্তু তুমি /নেই বাহিরে-- /অন্তরে মেঘ /করে ৪/৪/৪/২


ভারি ব্যাপক/ বৃষ্টি আমার/ বুকের মধ্যে /ঝরে!৪/৪/৪/২


দেখা যাচ্ছে নির্ভুল স্বরবৃত্ত ছন্দে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতাটি লিখেছেন।৪/৪/৪/২ এর একটি ভারি সুন্দর কবিতা এটি।


খ্যতিমান কবিদের কবিতা ছন্দ মেনেই লেখা।সেগুলো পাঠের সময়ে আমরা এবারে ছন্দপাঠ করতে চেষ্টা করব।এভাবেই একদিন সঠিক ছন্দে কবিতা আসবে সব কবির কলমে।আর ছন্দ পাঠ একবার করতে শিখলেই বুঝতে পারা যাবে, তা কবিতা পাঠের চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক।


২.অক্ষরবৃত্ত ছন্দ

-----------------


বাংলা তিন ছন্দের মধ্যে অক্ষরবৃত্তের স্থান সবার উপরে।মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সেরা বাংলা কবিতাগুচ্ছ লেখা হয়েছে।


স্বরবৃত্ত যেন এক শিশু। গড়গড় করে কবিতা বলে।মাত্রাবৃত্ত যেন এক যুবক।একটু আধটু বুঝেছে।আর অক্ষরবৃত্ত হল পরিণত মানুষ।বুঝে শুনে মতামত দেয় গম্ভীর ভাবে।


অক্ষরবৃত্ত এক সর্বগ্রাসী ছন্দ।যুক্তাক্ষরকে অনায়াসে গিলে খায়।অনেক বাংলা শব্দ চার অক্ষরের।কিন্তু উচ্চারণ হয় তিন অক্ষরের মত।এদের তিন মাত্রাই দেয় অক্ষরবৃত্ত। যেমন-


চারজন, হাড়গিলে, কাতরাতে, কলকাতা, বুলবুলি উচ্চারণের সময়ে হয়ে যায় চার্জন,হার্গিলে,কাত্রাতে,কল্কাতা, বুল্বুলি। তাই এদের মূল্য তিন, চার নয় অক্ষরবৃত্তের কাছে।মাত্রাবৃত্ত কিন্তু এদের পুরো চার মাত্রার মূল্য দেয়।এটাই অক্ষরবৃত্তের সঙ্গে মাত্রাবৃত্তের প্রধান পার্থক্য।


একই ভাবে কিছু তিন অক্ষরের শব্দ উচ্চারণ এর সময়ে গুটিয়ে দুই অক্ষরের শব্দে পরিণত হয়।তাই তাদের মূল্য দু মাত্রা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।যেমন- বাজনা, খাজনা, সজনে ইত্যাদি গুটিয়ে গিয়ে বাজ্না,খাজ্না,সজ্নে হয়ে যায়।আসলে লেখার অক্ষর নয়, উচ্চারণের কানই ছন্দের প্রধান অঙ্গ। এবং তাইই হওয়া উচিত কারণ, ভাষা যতটা না লেখার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি বলা ও শোনার জন্য।


তাই চোখ নয়, কান।কানের উপরেই নির্ভর করতে হবে ছন্দের জন্য।ছন্দ আসলে গানের মতই শোনার জিনিস।আর গান মানেই তো কান।তান আর কান না থাকলে গান কে শুনবে?


অক্ষরবৃত্ত ছন্দে একটা সুরেলা তান থাকে।এই কারণেই একে তানপ্রধান ছন্দও বলা হয়।'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি... ' বা 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে' লাইনগুলোর তান লক্ষ্য করুন।


এবারে আসব অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সহজে কবিতা লেখার আলোচনাতে।কারণ আমরা ছান্দসিক হতে চাই না, কবি হতে চাই।


এই ছন্দে কবিতা লেখা খুব সহজ।কারণ মোটামুটি যত অক্ষর, তত মাত্রা।শুধু খেয়াল রাখতে হবে উচ্চারণের সময়ে অক্ষরগুলো গুটিয়ে যাচ্ছে নাকি।গুটালেই মাত্রা কমবে।যুক্ত অক্ষরকে একটি অক্ষরেরই মূল্য দেয় এই ছন্দ।


তিনের পাশে তিন, দুই এর পাশে দুই এই হল মূলমন্ত্র অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখার।বিজোড়ে বিজোড় গাঁথ, জোড়ে গাঁথ জোড়।শুধু এটুকু মনে রেখে মনের সুখে কবিতা লিখুন এই ছন্দে।একদম সঠিক কবিতা হবে।


আসুন আমরা লিখি কিছু।


কি নিয়ে লেখা যায়? প্রেম? ভাল, ভাল।প্রেম অতি উপাদেয় উপাদান কবিতা লেখার।শুধু মাথায় রাখছি তিনের পাশে তিন আর দুই এর পাশে দুই।


ওগো নারী,


তোমার সাজানো ঘরে দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে পারি?


পেতে পারি পিপাসার জল?


পেরিয়ে এসেছি মরুভূমি,অনেক যুদ্ধের কোলাহল।


বড় ক্লান্ত আজ


তোমার বাগানে বসে বাজাব এস্রাজ।


এবারে যা লেখা হল তার ছন্দ বিশ্লেষণ :-

ওগো /নারী,২/২

তোমার /সাজানো /ঘরে ৩/৩/২

দুদণ্ড /বিশ্রাম/ নিতে/ পারি?৩/৩/২/২

পেতে/ পারি/ পিপাসার/ জল?২/২/৪/২

পেরিয়ে/ এসেছি/ মরুভূমি,৩/৩/৪

অনেক/ যুদ্ধের/ কোলাহল।৩/৩/৪

বড় /ক্লান্ত /আজ ২/২/২

তোমার /বাগানে /বসে ৩/৩/২

বাজাব /এস্রাজ।৩/৩

শেষ লাইনে 'বাজাব' না লিখে যদি 'বাজবে' লিখতাম তা হলে কি হত? 'বাজবে' সঙ্কুচিত হয়ে হয়ে যেত 'বাজ্বে' যা দু মাত্রার।ফলে দুই এর পাশে তিন হয়ে ভুল হয়ে যেত।

'পিপাসার জল', (৪/২)না লিখে যদি লিখতাম 'তৃষ্ণার জল' (৩/২)তাহলেও ভুল হয়ে যেত।বিজোড়ে জোড় গাঁথা হয়ে যেত।যদিও অর্থ একই থাকত।শব্দচয়ন কত গুরুত্ববহন করে, সেটা এখান থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে।

মাত্রা গোনার নিয়ম যত অক্ষর, তত মাত্রা।তবে উচ্চারণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

উচ্চারণের গুরুত্ব বুঝবার জন্য একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করুন।

"কালকা মেলে টিকিট কেটে সে

কাল গিয়েছে পাহাড়ের দেশে।"

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এই দু-লাইনের কবিতা দেখুন।


কালকা  মেল উচ্চারণে হচ্ছে কাল্কা মেল, আর 'কাল গিয়েছে ' যদিও দুটি আলাদা শব্দ, পাশাপাশি বসার জন্য উচ্চারিত হচ্ছে 'কাল্গিয়েছে' হিসাবে।ছান্দসিক কবি একে বলেছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের অসবর্ণ বিবাহ!


ছন্দ বিশ্লেষণ :-


"কালকা মেলে/ টিকিট/ কেটে সে ৪/৩/৩


কাল গিয়েছে/ পাহাড়ের/ দেশে।"৪/৪/২


কাল্কামেল ৪ মাত্রা।কাল্গিয়েছে ৪ মাত্রা।দুটি সমমাত্রিক লাইন।১০ মাত্রার।৪+৩+৩=৪+৪+২


বিজোড়ে বিজোড়,  জোড়ে জোড় হিসাবে লেখা।তাই সঠিক অক্ষরবৃত্ত।


জীবনানন্দ দাসের বেশিরভাগ কবিতা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা।জীবনানন্দের কবিতা পড়ুন আর ছন্দ নিজে বিশ্লেষণ করুন।


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,


যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;


যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই


পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।


যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি


এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়


মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা


শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।


জীবনানন্দের 'অদ্ভূত আঁধার এক'- কবিতাটির বিশ্লেষণ :-


অদ্ভুত আঁধার এক/৩-৩-২ এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/৪-৪-২


যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি/২-২-৪-২


আজ চোখে দ্যাখে তারা;/২-২-২-২


যাদের হৃদয়ে কোনো/৩-৩-২ প্রেম নেই – প্রীতি নেই –/২-২-২-২ করুণার আলোড়ন নেই/৪-৪-২


পৃথিবী অচল আজ/৩-৩-২


তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/৩-৫-২


যাদের গভীর আস্থা/৩-৩-২ আছে আজো মানুষের প্রতি/২-২-৪-২


এখনো যাদের কাছে/৩-৩-২


স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/৪-২-২-২


মহত্‍‌ সত্য বা রীতি,/৩-৩-২


কিংবা শিল্প অথবা সাধনা / ২-২-৩-৩


শকুন ও শেয়ালের খাদ্য/৪-৪-২


আজ তাদের হৃদয়/ ২-৩-৩


দেখা যাচ্ছে নির্ভুল অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা। বিজোড়ে বিজোড়,  জোড়ে জোড় গাঁথা হয়েছে।সঙ্গে রয়েছে একটানা এক তানের প্রবাহ।দুই অক্ষরের শব্দের পাশে তিন অক্ষরের শব্দ বসানোর জন্য মাঝখানে এক অক্ষরের শব্দ নিয়ে আসা হয়েছে।এভাবেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে হয়।


৩.মাত্রাবৃত্ত ছন্দ


মাত্রাবৃত্ত ছন্দ


রবীন্দ্রনাথের 'মানসী ' পর্বের কবিতায় মাত্রাবৃত্তের আবিষ্কার। কবির কথায়, " যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।"


এই ছন্দে যুক্ত অক্ষরকে দুটো অক্ষরের সমান ধরা হয়।তাই দুই মাত্রা পায় একটি যুক্তাক্ষর।


রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুন কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা।


ফাল্গুনে বিকশিত  কাঞ্চন ফুল ,


ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল ।


চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায় ,


বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায় ।


স্পন্দিত নদীজল ঝিলিমিলি করে ,


জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি বালুকার চরে ।


এখানে যুক্তাক্ষরগুলোকে ভেঙে ভেঙে পড়তে হবে।ফাল্গুন হবে ফালগুন।এখানে চারটি অক্ষর।তাই চার মাত্রা পাবে ফাল্গুন শব্দটি।এভাবে কাঞ্চন হবে কানচন।৪ মাত্রা পাবে।পুন্ জিত আমরোমুকুল একই ভাবে আসবে।


ছন্দ বিশ্লেষণ :-


ফাল্গুনে /বিকশিত-(৪/৪)  কাঞ্চন /ফুল ,(৪/২)


ডালে /ডালে/ পুঞ্জিত-(২/২/৪)আম্রমুকুল ।(৬)


চঞ্চল /মৌমাছি (৪/৪)গুঞ্জরি /গায় ,(৪/২)


বেণুবনে /মর্মরে (৪/৪)দক্ষিণবায় ।(৬)


স্পন্দিত /নদীজল-(৪/৪)ঝিলিমিলি করে ,(৪/২)


জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি-(৪/৪)বালুকার চরে ।(৪/২)


'স্পন্দিত' শব্দটাকে লক্ষ্য করুন।এটা ৪ মাত্রা পেয়েছে। ৫ মাত্রা পায়নি।যদিও দুটো যুক্তাক্ষর আছে।শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে সেটা এই ছন্দে এক মাত্রাই পায়।মধ্যে বা অন্তে যুক্তাক্ষর থাকলে তবেই তা দুই মাত্রা পায়।


অক্ষরবৃত্ত যেমন শব্দগুলোকে গুটিয়ে নিতে চায়,মাত্রাবৃত্ত ঠিক উল্টো ভাবে যুক্তাক্ষরগুলোকে ভেঙে ছড়িয়ে দেয়।মাত্রাবৃত্ত দুই মাত্রা দেয় একটি যুক্তাক্ষরকে।


এসব দেখে মনে হয়,মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে লেখা উচিত মাত্ রাবৃত্ ত  ছন্ দ।


মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গুনতে হবে যুক্তাক্ষরকে দুমাত্রা ধরে।বাকি সব অক্ষর এক মাত্রার।অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যুক্তাক্ষর এক মাত্রা পায়।এটাই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সংগে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা হিসাবের ফারাক।উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, 'ছন্দ' শব্দটি অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা কিন্তু মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা পাবে।মুক্তদল এক মাত্রা, রুদ্ধদল দুই মাত্রা পায় মাত্রাবৃত্তে।ছন্দ শব্দে 'ছন্ 'হল রুদ্ধদল, ২ মাত্রা পাচ্ছে তাই।আর 'দ ' মুক্তদল, এক মাত্রা পাবে।


মাত্রাবৃত্ত হল মধ্যম লয়ের ছন্দ।স্বরবৃত্তের মত টগবগ করে ছোটে না, আবার অক্ষরবৃত্তের মত গজেন্দ্রগমন ও করে না।


যেমন, নিচের চারটি লাইন দেখুন:-


মনের মানুষ /কপালে কি কারো /থাকে?


চুপিচুপি তাকে /মনেই থাকতে /দাও,


স্বপ্নেরা শুধু/ স্বপ্ন হয়েই /থাকে


স্বপ্নটা ভুলে /বাস্তব মেনে/ নাও।


এখানে ৬/৬/২ মাত্রার মাত্রাবৃত্তের চাল দেখতে পাচ্ছি।স্বপ্ন, শব্দটি তিন মাত্রা পেয়েছে।প্রাথমিক যুক্তাক্ষর-' স্ব' একমাত্রা আর পরের যুক্তাক্ষর 'প্ন' দুই মাত্রা পেয়েছে।


' বাস্তব 'চার মাত্রা পেয়েছে।কারণ যুক্তাক্ষরটি মাঝখানে আছে।যুক্তাক্ষর মাঝখানে বা শেষে থাকলেই দু মাত্রা আদায় করে ছাড়বে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে।শব্দের প্রথমেই যুক্তাক্ষর থাকলে একমাত্রা পাবে।


মাত্রাবৃত্ত চার রকমের হতে পারে।৪ মাত্রা, ৫ মাত্রা, ৬ মাত্রা ও ৭ মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত হয়।


ফাল্গুনে/ বিকশিত/ কাঞ্চন/ ফুল -(৪/৪/৪/২) - এটা হল চার মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত।


এবারে জয় গোস্বামীর দুটি লাইন দেখুন:-


"বেনীমাধব বেনীমাধব তোমার বাড়ি যাব- বেনীমাধব,তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?"


বিশ্লেষণ :-


বেনীমাধব /বেনীমাধব/ তোমার বাড়ি/ যাব-(৫/৫/৫/২)- বেনীমাধব/ তুমি কি আর /আমার কথা /ভাবো?(৫/৫/৫/২)


এটা হল পাঁচ মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত।


এটাকে আমরা ৫/৭ হিসাবেও ভাবতে পারি, শেষ দু মাত্রাকে এক সংগে ধরে।


এবারে ৬ মাত্রার চাল দেখুন মাত্রাবৃত্ত ছন্দে:-


জীবনানন্দ কবিতার কারিগর


এই বাংলায় ধানসিড়িটির তীরে


হয়তো বা হাঁস নয়তো অন্য রূপে


বাংলার কবি ঠিক আসবেন ফিরে।


বিশ্লেষণ :-


জীবনানন্দ /কবিতার কারি/গর(৬/৬/২)


এই বাংলায়/ ধানসিড়িটির /তীরে(৬/৬/২)


হয়তো বা হাঁস /নয়তো অন্য /রূপে(৬/৬/২)


বাংলার কবি /ঠিক আসবেন /ফিরে। (৬/৬/২)


৬ মাত্রার চাল, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। এটাকেও ৬/৮ হিসাবে বলা যায় শেষ দু মাত্রকে এক সংগে ধরে।


এবারে ৭ মাত্রার চাল:-


সেটা স্পষ্ট ভাবে খোদাই হয়ে আছে


সেটা মরতে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠে


তাকে মারব বলে মিথ্যে ছোটাছুটি


সেটা রোজ সকালে পদ্ম হয়ে ফোটে।


বিশ্লেষণ :-


সেটা স্পষ্ট ভাবে /খোদাই হয়ে আছে/(৭/৭)


সেটা মরতে গিয়ে/ আবার বেঁচে ওঠে(৭/৭)


তাকে মারব বলে /মিথ্যে ছোটাছুটি(৭/৭)


সেটা রোজ সকালে /পদ্ম হয়ে ফোটে।(৭/৭)


এটা হল মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৭ মাত্রার চাল।


এমন ৭ মাত্রার চালে আরও চার লাইন লেখা যাক।


সেটা হারিয়ে গেলে/ দারুণ ভাল হত


সেটা অনেক বেশি /কষ্ট বয়ে আনে


সেটা দিনের শেষে/ নিদ্রা কেড়ে নেয়


সেটা কাঁটার মত/ বিঁধেই থাকে প্রাণে।


৭/৭ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত।


এবারে আরও একটা কবিতা দেখুন।


পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণাটা নামে


অনেক না বলা কথা আছে নীলখামে।


ঝর্ণারা মিলেমিশে হয়ে যায় নদী


শুনবে নদীর গান, কান পাতো যদি।


ও নদী কোথায় যাও? ছলছল তানে?


দাও নদী দাও বলে, জীবনের মানে।


ঘন্টার ঠুনঠুন, আজানের সুর;


নদী জলে মিশে যায় সোনারোদ্দুর।


বিশ্লেষণ :-


পাহাড়ের বুক চিরে/ ঝর্ণাটা নামে(৮/৬)


অনেক না বলা কথা/ আছে নীলখামে।(৮/৬)


ঝর্ণারা মিলেমিশে/ হয়ে যায় নদী(৮/৬)


শুনবে নদীর গান, /কান পাতো যদি।(৮/৬)


ও নদী কোথায় যাও?/ ছলছল তানে?(৮/৬)


দাও নদী দাও বলে,/ জীবনের মানে।(৮/৬)


ঘন্টার ঠুনঠুন, /আজানের সুর;(৮/৬)


নদী জলে মিশে যায়/ সোনারোদ্দুর।(৮/৬)


এটা হল ৮/৬ এর মাত্রাবৃত্ত। কিন্তু ৮ মাত্রা কে আমরা দুটি ৪ মাত্রার যোগফল হিসেবে ভাবতে পারি।তাই ৮ মাত্রার চালকে ৪ মাত্রার দুটি চালের সমন্বয় হিসাবে ধরা হয়।উপরের 'ফাল্গুনে বিকশিত/ কাঞ্চন ফুল' এই লাইনটাকেও ৮/৬  হিসাবে বলা যেতে পারত।যেহেতু ৮ মাত্রা দুটি ৪ মাত্রার সমন্বয়,  তাই এই ধরনের কবিতাকে চার মাত্রার মাত্রাবৃত্ত হিসাবেই ধরা হয়।চোখে দেখে ' ঘন্টার ঠুনঠুন ' এই পর্বটিকে 'আজানের সুর' এর চেয়ে ছোট মনে হচ্ছে।কিন্তু 'ঘন্টার ঠুনঠুন' ৮ মাত্রার পর্ব।'আজানের সুর' ৬ মাত্রার। এজন্য মাত্রা বিচার খুব জরুরি। একই শব্দ তিন ছন্দে তিন রকম মাত্রার হতে পারে।এবিষয়ে খুব মনোযোগ দেওয়া দরকার।


মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখার সময় মনে রাখতে হবে এটা মধ্যম লয়ের ছন্দ।যুক্তাক্ষরগুলোকে দুটো আলাদা অক্ষর হিসাবে ধরতে হবে। যুক্তাক্ষরটি শব্দের প্রথমেই থাকলে কিন্তু এক মাত্রা পাবে।এটা মনে রাখা চাই।যেমন:-শ্মশান, স্তবক, শ্বশুর তিন মাত্রা পাবে।চার মাত্রা নয়।কারণ, যুক্তাক্ষর থাকলেও সেটা শব্দের শুরুতেই আছে।মাঝখানে বা শেষে যুক্তাক্ষর থাকলে কিন্তু দু-মাত্রা আদায় করবে এই ছন্দে।এটুকু মনে রেখে ৪/৫/৬/৭ মাত্রার চালে মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখলে ভুল হবার কথা নয়।


সুকুমার রায়ের ৪ মাত্রার একটা মজার মাত্রাবৃত্তের কবিতা দিয়ে আলোচনা শেষ করছি।


সব যেন /বিচ্ছিরি /সব যেন /খালি


গিন্নীর /মুখ যেন /চিমনীর/ কালি।


মন ভাঙা /দুখ মোর /কন্ঠেতে /পুরে


আয় ভাই /গান গাই/ প্রাণফাটা/ সুরে।


মহিলা কবিদের কি হবে জানি না,কিন্তু বেশি কবিতা লিখলে বিবাহিত পুরুষ কবিদের গিন্নীর মুখে চিমনীর কালি দেখা যাবেই।তবু বুকে সাহস রেখে প্রাণভরে মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখুন...


৪.মাত্রা ও ছন্দ নির্ণয়

--------------------


বিখ্যাত ইংরেজ কবি কোলরিজ গদ্য আর পদ্যের কার্যকর একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর বিবেচনায় গদ্য বা Prose হচ্ছে ‘Words in the best order’ অর্থাৎ শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই গদ্য। আর কবিতা বা Poetry হচ্ছে ‘Best words in the best order’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই কবিতা। এর মাধ্যমে কবিতা বা গদ্য কি তা বোঝা কঠিন। কিন্তু গদ্য বা কবিতা কিভাবে লিখতে হবে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।


কবিতার ক্লাসের আগের আলোচনাগুলোতে বাংলা কবিতার তিন ছন্দ নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দিতে চেষ্টা করেছি।আজকে আলোচনা করব কিভাবে ছন্দের নিয়ম মেনে কবিতা লেখা যায়।


ফুলের সঙ্গে ফুল গেঁথে যেমন মালা তৈরি হয়, ঠিক তেমন ভাবে শব্দে শব্দ গেঁথে কবিতা লেখা হয়।ভাল মালা গাঁথতে গেলে কোন ফুলটা কোন ফুলের পাশে ভাল মানাবে সেটার ধারণা থাকা দরকার। যে কোনও ফুল ইচ্ছেমত গাঁথলেই তা সুন্দর মালা হবে না কখনও।কবিতার ক্ষেত্রেও এটাই সত্য।শব্দ চিনতে হবে।শব্দের ওজন বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার করে নিতে হবে কবিতা লেখার আগেই।একই শব্দ বিভিন্ন ভাবে সাজালে তার ওজনের বিভিন্নতা দেখা দেয়।


ছন্দ শাস্ত্রে এই ব্যাপারটা মাত্রা দিয়ে মাপা হয়।


আগেই বলেছি স্বরবৃত্ত ছন্দে যত দল ( সিলেবেল) তত মাত্রা।কোনটা রুদ্ধ দল আর কোনটা মুক্তদল এসব কিচ্ছু দেখার দরকার নেই স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখার সময়ে।


তাই যেকোনো শব্দে যতগুলো দল, ঠিক তত মাত্রা হবে এই ছন্দে।উদাহরণ হিসাবে বলা যায়,  "কোন দেশেতে / তরুলতা " এই বাক্যে  কোন+ দে+শে+তে/ ত+রু+ল+তা,৪+৪ মোট আটটি দল বা সিলেবল আছে।তাই এটা আট মাত্রিক একটা বাকাংশ।


সব ছন্দেই মুক্তদল একমাত্রা।রুদ্ধদল স্বরবৃত্তে এক মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে দুই মাত্রা আর অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এক বা দুই মাত্রা পায়।


রুদ্ধদল একা থাকলে বা শব্দের শেষে থাকলে দুই মাত্রা পায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।শব্দের শুরুতে বা মাঝে রুদ্ধদল এক মাত্রা পায় অক্ষরবৃত্তে।


যেমন, "অক্ষর " শব্দটাতে অক+খর মোট দুটি দল আছে।প্রথম  রুদ্ধদলটি যেহেতু শব্দের প্রথমে আছে, তাই এক মাত্রাই পাবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।আর শেষেরটি দুই মাত্রা পাবে। তাই শব্দটা তিন (১+২)মাত্রা পাবে এই ছন্দে।


কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এটা চারমাত্রা পাবে।কারণ, দুটি রুদ্ধদল প্রত্যেকেই দুই মাত্রা পাবে মাত্রাবৃত্তে।


এবারে একটা মজা দেখা যাক।আসলে আমরা কবি হতে চাই।ছান্দসিক নই।তাই শুধুমাত্র চোখে দেখেই সহজে এই মাত্রা নির্ণয় করতে পারলে খুব ভাল হয় আমাদের জন্য।


এই জন্য নিয়ম হল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যত অক্ষর তত মাত্রা।আর মাত্রাবৃত্ত ছন্দে যুক্তাক্ষর দুই মাত্রা। তাহলে শুধু চোখে দেখেই এবারে আসুন মাত্রা গুনে নিই।


'ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল' এর মাত্রা নির্ণয় করব আমরা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ৩+৪+৩+২ =১২মাত্রা পাবে লাইনটি।কারণ, ফাল্গুনে তিন অক্ষর, বিকশিত ৪ অক্ষর, কাঞ্চন তিন অক্ষর, আর ফুল দুই অক্ষরের শব্দ।


কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দে যেহেতু যুক্তাক্ষর দুই মাত্রা পাবে তাই ফাল্গুনে হবে চার মাত্রার।কাঞ্চন ও চার মাত্রা পাবে এখানে।লাইনটি ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে।


দল হিসাবে পরিমাপ করেও একই রেজাল্ট পাওয়া যাবে।সুতরাং কবিতা লেখার সময়ে শুধুমাত্র শব্দটার দিকে একবার তাকালেই আমরা তার মাত্রা বের করে নিতে পারব এই ভাবে।রুদ্ধদল মুক্তদলের ঝামেলাতে না গিয়েও খুব সহজেই।


এবারে কবিতা লেখার পালা।তবে কবিতা লেখার আগে আমি অনুরোধ করব কবিতা পড়ে, কোন কবিতা কোন ছন্দে সেটা খুঁজে বের করার খেলাটা খেলতে।যতদিন না এটা করতে পারা যাচ্ছে ততদিন কবিতা লেখা সম্ভব নয় ছন্দ মেনে।


এখন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে বুঝব কোন কবিতা কোন ছন্দে লেখা?


এটা খুবই সহজ কাজ।যেকোনও কবিতার প্রথম দুই লাইন পড়লেই এটা ধরতে পারা উচিত। লয় টা কেমন? দ্রুত, না ধীর? ধীর হলে অক্ষরবৃত্ত হবে।আর দ্রুত হলে স্বরবৃত্ত। মাত্রাবৃত্ত মাঝারি লয়ের।


কয়েকটি কবিতার লাইন মনে রাখুন শুধু।


১ .  আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়।


বা,


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,


যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা


...- অক্ষরবৃত্ত।  


২.ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল


বা,  শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভূঁই, আর সবই গেছে ঋণে।.... মাত্রাবৃত্ত।


৩. বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই.....স্বরবৃত্ত ছন্দ।


এবারে  তুলনা করুন যে কবিতার ছন্দ ধরতে চাইছেন তার সঙ্গে। যেটার সঙ্গে মিলবে সেই ছন্দ হবে।


এর সঙ্গে জেনে নিতে হবে কিছু কায়দা।যেমন বিজোড়ে বিজোড়, জোড়ে জোড় শব্দ দেখলে বুঝতে হবে অক্ষরবৃত্ত। যদি দেখা যায় দুটি তিন অক্ষরের শব্দ পাশাপাশি বসেছে একটিতে যুক্তাক্ষর আছে আর একটিতে নেই তাহলে বুঝতে হবে কনফার্ম অক্ষরবৃত্ত। কারণ মাত্রাবৃত্ত হলে যুক্তাক্ষর যুক্ত শব্দটি চার মাত্রার হয়ে যেত।একই ভাবে দুটি দু অক্ষরের শব্দ পাশাপাশি বসলেও একটিতে যুক্তাক্ষর থাকলে অক্ষরবৃত্ত হবে।  যুক্তাক্ষরটিই আপনাকে বলে দেবে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত না অক্ষরবৃত্ত। যুক্তাক্ষর দু মাত্রা পেলেই মাত্রাবৃত্ত।নইলে অক্ষরবৃত্ত।  


যেমন উপরের উদাহরণে ' অদ্ভুত আঁধার এক'  শুধু এই বাকাংশটুকুই ছন্দ নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট। 'অদ্ভুত' শব্দটিতে যেহেতু যুক্তাক্ষর আছে, আর 'আঁধার' শব্দে নেই তাই এটা মাত্রাবৃত্ত হতে পারে না।অক্ষরবৃত্তের কবিতার পর্ব বিজোড় হয় না কখনো। ওদিকে মাত্রাবৃত্ত পাঁচ মাত্রায় সবচেয়ে ভাল চলে।


চার মাত্রা চারমাত্রার তাড়াতাড়ি চাল মানেই স্বরবৃত্ত।উচ্চারণের প্রথমেই শ্বাসাঘাত আসলে বুঝতে হবে স্বরবৃত্ত। যেমন 'বাঁশ বাগানে'  বলতে গেলেই 'বাঁ' এর উপরে জোর পড়ছে। স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতি চারমাত্রার প্রথম মাত্রার উপর জোর পড়ে।

আগেই বলেছি ছন্দ শিক্ষার জন্য ছন্দে লেখা কবিতার বিশ্লেষণ জরুরী।কবিতা পাঠের সঙ্গে আমরা করব ছন্দ পাঠ।


ডাক্তারি শেখার জন্য যেমন মানুষের শরীর কাটা-ছেঁড়া  করতে হয়, সেভাবেই কবিতার কাটা-ছেঁড়াও খুব দরকার কবিতা লেখার জন্য।


আর একটা কবিতা দেখা যাক।


"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে জ্যোৎস্না করি পান

আধেকলীন অতীতে ওড়ে চন্দ্রযান।

অনিকেত পথে-পথে, গভীর প্রদেশে;

হঠাৎ দাঁড়াচ্ছ তুমি এক চিলতে হেসে।

তুলে আনছি পান্না-হীরে-মুক্তো কিছু কিছু

ইতিহাস জাপটে ধরে, ছাড়ে না তো পিছু।

ভূতকাল ভবিষ্যৎ পাশাপাশি হাঁটে

স্বপ্নবৎ বর্তমান সময়টা কাটে।

দুঃখ-সুখের লব্ধিতে, চক্রব্যূহ পথে

যুযুধান লড়ে চলি অসম দ্বৈরথে।"


কবিতাটি কোন ছন্দের? কী করে বুঝবো?


প্রথম লাইনটি দেখুন।

"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে জ্যোৎস্না করি পান"

প্রথম দুটি তিন অক্ষরের শব্দ।একটিতে যুক্তাক্ষর আছে, আর একটিতে নেই।এটাই বলে দিচ্ছে কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দের।পড়তে গিয়ে আমরা, 'প্রপঞ্চে চকোর-রূপে' এর পরে একটু থেমে যাচ্ছি।যদিও কোনও কমা দেওয়া নেই।

এটাকে বলা হয় কবিতার 'যতি'। আমরা পড়ছি, "প্রপঞ্চে চকোর-রূপে, /জ্যোৎস্না করি পান" মাত্রা বিশ্লেষণ করলে, ৩-৩-২/২-২-২

জ্যোৎস্না শব্দটি দুই মাত্রার।যদিও দেখে তিন মাত্রার মনে হচ্ছে।আসলে,উচ্চারণে গুটিয়ে এটা জ্যোস্না হয়ে যাচ্ছে।

"এক চিলতে হেসে" তে 'চিলতে' দুই মাত্রা পাচ্ছে।তিন নয়।কারণ? সেই উচ্চারণ। 'চিল্তে' হয়ে যাচ্ছে শব্দটা।একই ঘটনা "তুলে আনছি" এর 'আনছি' তে।এটা 'আন্ছি'।

তাই বলে কি ' আনছি' তিন মাত্রা পেতে পারে না অক্ষরবৃত্ত ছন্দে? উওরে বলা যায়, পারে।উচ্চারণ ডিমান্ড করলেই পারে।

'জাপটে' শব্দটাও এখানে 'জাপ্টে' হিসাবে পড়া যায়।তাই দুই মাত্রা পাচ্ছে।

এবারে ছন্দ বিশ্লেষণ করা যাক।


"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে /জ্যোৎস্না করি পান

৩-৩-২/২-২-২

আধেকলীন অতীতে /ওড়ে চন্দ্রযান।

৫-৩/২-৪

অনিকেত পথে-পথে, /গভীর প্রদেশে;

৪-২-২/৩-৩

হঠাৎ দাঁড়াচ্ছ তুমি/ এক চিলতে হেসে।

৩-৩-২/২-২-২

তুলে আনছি পান্না-হীরে-/মুক্তো কিছু কিছু

২-২-২-২/২-২-২

ইতিহাস জাপটে ধরে, /ছাড়ে না তো পিছু।

৪-২-২/২-১-১-২

ভূতকাল ভবিষ্যৎ /পাশাপাশি হাঁটে

৪-৪/৪-২

স্বপ্নবৎ বর্তমান/ সময়টা কাটে।

৪-৪/৪-২

দুঃখ-সুখের লব্ধিতে, /চক্রব্যূহ পথে

২-৩-৩/৪-২

যুযুধান লড়ে চলি /অসম দ্বৈরথে।"

৪-২-২/৩-৩


দেখা যাচ্ছে ৮/৬ অক্ষরবৃত্তে আছে কবিতাটি।

আধেকলীন শব্দটিকে অক্ষরবৃত্ত 'আধেক্লীন' হিসাবে চার মাত্রার শব্দে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে।এখানে এটি ৫- মাত্রা হিসাবে ধরা হয়েছে।

কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এই সব মারপ্যাঁচ। আর সেটাকে ধরতে পারা কবিতা পাঠে আলাদা মজা এনে দেয়।


আরও একটা কবিতার উপরে ছুরি চালানো যাক।


"বৃষ্টি এলে শিউলিতলায়, ছাতিমগাছের ডালে

মনটা বড় কেমন করে বৃষ্টি-ঝরা কালে।

এখন তুমি অনেকদূরে না জানি কোনখানে,

ভিজছো কিংবা গুনগুনিয়ে সুর তুলেছো গানে।

তোমার গানের সেই সুরটাই বৃষ্টি হয়ে এসে

টাপুরটুপুর পড়ছে ঝরে মেঘকে ভালবেসে।

মেঘ বিরহী,কান্নাটা তার বৃষ্টি হয়ে ঝরে

তোমার বুঝি মেঘ দেখলেই আমায় মনে পড়ে?"


এটা কোন ছন্দ? 

দেখাই যাচ্ছে সুরটা আগের চেয়ে নরম।পড়াও যাচ্ছে অনেক দ্রুত।শ্বাসাঘাত আছে প্রতি প্রথম মাত্রায়।তাহলে এটা স্বরবৃত্ত।

বিশ্লেষণ করা যাক।


বৃষ্টি এলে /শিউলিতলায়, /ছাতিমগাছের /ডালে

মনটা বড় /কেমন করে /বৃষ্টি-ঝরা /কালে।

এখন তুমি /অনেকদূরে/ না জানি কোন/খানে,

ভিজছো কিংবা/ গুনগুনিয়ে/ সুর তুলেছো /গানে।

তোমার গানের/ সেই সুরটাই /বৃষ্টি হয়ে /এসে

টাপুরটুপুর /পড়ছে ঝরে /মেঘকে ভাল/বেসে।

মেঘ বিরহী,/কান্নাটা তার /বৃষ্টি হয়ে /ঝরে

তোমার বুঝি /মেঘ দেখলেই /আমায় মনে /পড়ে?


এটা ৪/৪/৪/২ মাত্রার স্বরবৃত্ত।এখানে মুক্তদল, রুদ্ধদল সাবাই সামান মাত্রা পেয়েছে।সব দল ১ মাত্রা।তিনটি রুদ্ধদল পাশাপাশি থাকলে কিন্তু চারমাত্রা পায় এই ছন্দে।যেমন, 'সেই সুরটাই' বা 'মেঘ দেখলেই',  এখানে দল তিনটি কিন্তু মাত্রা চার।'সেই',  'লেই' ইত্যাদি দলের শেষে স্বরবর্ণ আছে।কিন্তু এরা রুদ্ধ দল।কারণ,এখানে 'এ-ই',  দুটি স্বরবর্ণ পাশাপাশি আছে এবং একক প্রচেষ্টায় উচ্চারিত হচ্ছে।এটা হল যৌগিক স্বর।যৌগিক স্বরকে রুদ্ধদল ধরা হয়।


এভাবে যত বেশি কবিতা কাটা-ছেঁড়া  করা যাবে তত ভাল কবিতার ডাক্তার বা কবি হওয়া যাবে।আধুনিক গদ্য কবিতাতে ছন্দের অনেক জটিল মারপ্যাঁচ লুকিয়ে থাকে।যেটা কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকা একটা রহস্য।কবিতা আসলে নারীর মত,রহস্যময়ী।কিংবা পরোটার মত। কবিতার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে কত্ত কিছু! -প্রতীক, চিহ্ন, উপমা,কল্পনা, ছন্দ...


লেখকের কৈফিয়ৎ:

নিজেকে পন্ডিত বা ছান্দসিক প্রমাণ করার জন্য এই প্রবন্ধটি আমি লিখিনি।  বাজার চলতি ছন্দের বইগুলো পড়ে ছন্দের কবিতা লিখতে শেখা সত্যিই খুব শক্ত।এ ব্যাপারে প্রকৃত সাহায্য পাওয়া যায়না কোন কবির কাছ থেকেই। সত্যি কথা বলতে কি, খুব কম কবিই সঠিকভাবে ছন্দ জানেন। খুব কম বাংলার শিক্ষক ছন্দ মেনে কবিতা লিখতে শেখার কাজে সাহায্য করতে পারেন। প্রকৃত শিক্ষক না পাওয়ার ফলে অন্ধকারে একা একাই পথ খুঁজে বেড়াতে হয়। আমি যে বাধার সম্মুখীন হয়েছি,আজ নতুন যারা লিখতে আসছেন তারা যাতে সেই বাধার সম্মুখীন না হন, তারা যাতে সহজে ছন্দ শিখে কবিতা লিখতে পারেন সেইজন্য এই প্রবন্ধটি লেখা। এখানে আমি যে পদ্ধতিতে কবিতা লেখার কথা বলেছি তা প্রচলিত ছন্দের বইগুলো থেকে একটু আলাদা। আমার হাত পুড়িয়ে শেখা অভিজ্ঞতাগুলোই এই লেখাতে আমি শেয়ার করেছি। এতে যারা ছন্দ শিখে কবিতা লিখতে চান, তাদের যদি উপকার হয়, তাহলে আমি খুব খুশি হব। যাদের লেখাটি পড়তে ভালো লাগছে না,বা 'অসহ্য' বলে মনে হচ্ছে, তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।যারা ছন্দ না শিখে বা ছন্দ না মেনে কবিতা লিখতে চান তাদের সঙ্গেও আমার কোনো বিরোধ নেই। ছন্দ কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। ছন্দ ছাড়াও কবিতার অনেক ঐশ্বর্য আছে।  কবিতা আসলে মায়াবী সর্বগ্রাসী অখণ্ডমণ্ডলাকার ব্রহ্মাণ্ড স্বরূপ... কবিতাই উপনিষদের  ব্রহ্ম। যিনি মনে করেন কবিতা কি তা আমি জানি না, প্রকৃতপক্ষে তিনিই কবিতাকে বুঝতে পেরেছেন, আর যদি কেউ মনে করেন কবিতাকে আমি জেনেছি, তিনি কবিতাকে জানতে পারেননি। "যস্যামতং

 তস্য  মতং, মতং যস্য ন বেদ সঃ"।


Sudipta Biswas,Deputy Magistrate & Deputy Collector,(WBCS Exe.)

শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২০

কয়েকটি প্রিয় কবিতা



পাতকী

এসেছে প্রেমিক যুবা প্রেম ভেঙে গেলে,

পাষণ্ড পুলিশ থেকে ডাকাতের দল-

সব্বাই এসেছে, আর ঢেলে গেছে বিষ।

ধোয়া তুলসী পাতা যে, সেও তো এসেছে!

এঁটো পাতে চেটেপুটে খেয়ে চলে গেছে।

এসেছে উকিল বাবু, এসেছে সন্ন্যাসী;

মুখ পাল্টাতে এসেছে গৃহস্ত মানুষ।

এসছে জুতো বিক্রেতা, জুতো কেনে যারা,

তারাও এসেছে সব গাঁ উজাড় করে।

কী নেবে গো দেহ থেকে? দেহে কীইবা আছে?

নর দেহে যত পাপ সব মুছে নিয়ে

রক্ত-মাংস-বিষ মেখে অন্তরে-অন্তরে

ধর্ষিত হয়েছি রাতে অযুত বছর।

সমস্ত শরীর দিয়ে বিষ শুষে নিয়ে

অপবিত্র তবু আমি কুলটা, পাতকী!




কেমন আছ?


কঠিন বাস্তবতাকে ভুলতে,

বেশি কথা না বাড়াতে,

তেতো সত্যকে এড়াতে,

নিজেকে লুকোতে

আমরা সকলেই যে প্রশ্নের মিথ্যা উত্তর দিই সেটা হল,

'কেমন আছ?'

বুকের গভীরে যন্ত্রণা লুকিয়ে ভাল থাকি।

জামার অস্তিনে রক্তের দাগ লুকিয়ে ভাল থাকি।

সব ইচ্ছেগুলোকে এক এক করে মরে যেতে দেখে ভাল থাকি।

'ভাল আছি' কথাটার উচ্চারণের মধ্যেই কোথায় যেন একটা যন্ত্রণার মোচড় লেগে থাকে।

মিথ্যের মুখোশ খুলে ওই ছোট্ট কথা দুটির মধ্যেই উঁকি মেরে যায় আমাদের দোমড়ানো মোচড়ানো খারাপ থাকা।

আমরা জানি কেউ ভাল নেই,

তবুও জিজ্ঞাসা করি-

'কেমন আছ?'




কিছু কথা 

কিছু কথা না শোনাই ভাল

ভুলে যাওয়া ভাল কিছু কথা,

কিছু কথা শুধু ভেসে যায়

দাগ কাটে কিছু নিরবতা।

কিছু কথা যায় না তো ভোলা

কিছু কথা বেমালুম ভুলি,

কিছু কথা শুনে সুখ পাই

কিছু কথা বলে কান মুলি।

কিছু কথা, মানে নেই কোনও

কিছু কথা বড়ই ভাবায়,

কিছু কথা দেয় দূরে ঠেলে

কিছু কথা ডাকে, আয় আয়...

কিছু কথা, যেন পেঁজা তুলো

এদিক ওদিক যাক উড়ে,

কিছু কথা চড়ুক চিতায়

ছাই হয়ে যাক জ্বলে পুড়ে।

কিছু কথা, যাক থেমে যাক

কিছু কথা বল তুমি প্রিয়,

কিছু কথা ডাস্টবিনে রেখে

কিছু কথা বুকে তুলে নিও...





বৃষ্টি এলে

বৃষ্টি এলে বুকের ভিতর গোলাপ কুঁড়ি ফোটে

বৃষ্টি এলে মনটা বড় উদাস হয়ে ওঠে।

বৃষ্টি এলে শিউলিতলায়, ছাতিমগাছের ডালে

মনটা বড় কেমন করে বৃষ্টি-ঝরা কালে।

এখন তুমি অনেকদূরে না জানি কোনখানে,

ভিজছো কিংবা গুনগুনিয়ে সুর তুলেছো গানে।

তোমার গানের সেই সুরটাই বৃষ্টি হয়ে এসে

টাপুরটুপুর পড়ছে ঝরে মেঘকে ভালবেসে।

মেঘ বিরহী,কান্নাটা তার বৃষ্টি হয়ে ঝরে

তোমার বুঝি মেঘ দেখলেই আমায় মনে পড়ে?




আহ্বান 


গুমরে মরেছি শুধু মনের গভীরে।

অস্ফুট আর্তিতে আর অপেক্ষায় -অপেক্ষায়

বয়ে গেছে রক্তধারা এই যমুনায়।

রুধিরের স্রোত-জল বৃথা, সব বৃথা।

অনেক মায়াবী রাত ঝলমলে দিন,

নিতান্ত নিস্ফল তারা, অপুষ্পক স্মৃতি।

এখনও গোলাপবাগে আধফোটা কুঁড়ি,

ভ্রমরের স্পর্শ পেতে প্রচণ্ড উন্মুখ। 

প্রতীক্ষা,প্রতীক্ষা নিয়ে রাত ভোর জেগে

সরিয়ে রেখেছি পাশে বরমাল্য খানি।

তারার জন্মের পর তারার মৃত্যুতে,

চুপচাপ কাল স্রোতে বয়ে গেছে কাল।

নিঝুম দুপুর থেকে ধূসর বিকেলে 

অলিন্দে একাকী বসে দেখেছি জগত।

লুকিয়ে রেখেছি কত চোরাবালি স্রোত।

লুকিয়ে রেখেছি কত পক্ষবিধূনন।

আগ্নেয়গিরির সেই উদ্গিরণের মত

আজ আমি অভিসারী, রোমাঞ্চ পিয়াসী।

তুমি এসো, 

মুগ্ধতার সে প্রাচীন  আধিকার নিয়ে এসো, 

রুদ্ধদ্বারে বার বার কর করাঘাত।

তোমার উদ্ধত ফনায় আমাকে বিদ্ধ কর,

মুগ্ধ কর, কর শিহরিত, বাজিয়ে তোমার বীন

নিয়ে চল জ্যোৎস্নার মায়াবী জগতে।

তোমার ডানার স্বেদ বিন্দু 

গড়িয়ে পড়ুক আমার ডানায়।

কানায় কানায় উপচে উঠুক রসস্রোত। 

পিয়াসী তৃষ্ণার্ত বুকে ঢেলে দাও অমৃত তোমার ...




উল্টোপুরাণ


এইতো কদিন আগেও তোমরা

আগুন লাগালে বনেতে,

নৃশংস ভাবে পুড়লো পশুরা

দাগ কেটেছিল মনেতে?


বিষ ছড়িয়েছ আকাশে বাতাসে

বিষ ছড়িয়েছ জলেতে

বনকে পুড়িয়ে পাহাড় গুঁড়িয়ে

দুনিয়া ভরেছ কলেতে।


ময়না চড়ুই হারিয়ে গিয়েছে

তোমার লোভের জ্বালাতে

ডোডো পাখিদের মতই তারাও

পথ পায়নি তো পালাতে।


পশুপাখি ধরে খেয়াল খুশিতে

বাঁদর নাচন নাচাতে

বহু পাপ করে অবশেষে তুমি

বন্দি এখন খাঁচাতে।


পাখিরা উড়ছে মুক্ত আকাশে

মানুষ বন্দি খাঁচাতে,

কতদিন পরে জীবকূল খুশি

করোনা এসেছে বাঁচাতে।


বৃষ্টি

বৃষ্টি রে তুই দুষ্টু ভারি, তোর গলাতে সেই চেনা সুর!

ঘরের ছাদে গাছের পাতায়,বাজছে রে তোর পায়ের নূপুর!

বৃষ্টি কোথায় পেলি এ গান? বল না বৃষ্টি বল না আমায়,

একলা যখন কাঁদে এ মন, তোর গানে সেই কান্না থামায়।

বৃষ্টি রে তুই থাকিস কোথায়? আকাশপারে মেঘের দেশে?

কী আছে সেই অচিন দেশে, বল না বৃষ্টি মিষ্টি হেসে।

টিপ-টিপ-টিপ বৃষ্টি রে তুই, ঝর না এখন অঝোর-ধারায়,

রিম-ঝিম-ঝিম নূপুর বাজে, তোর সুরে এই মনটা হারায়।

বৃষ্টিরে আর কেউ না বুঝুক, তুই তো বুঝিস মনটা আমার,

তোর সুরে আজ উঠছে বেজে, বাউলমনে ধ্রুপদ-ধামার।

মনটা যে চায়, যাই চলে যাই, তোর সাথে আজ অনেক দূরে -

নদী-পাহাড়-বন পেরিয়ে, নতুন দেশে, অচিনপুরে।

সেই দেশে এক দুঃখী মেয়ে, আমার মতোই একলা ভারি,

সবাই তাকে ভুল বুঝেছে, তার সাথে ভাই দিস্ না আড়ি।

রিম-ঝিম-ঝিম গানটা গেয়ে, আমার কথা বলবি তাকে,

মনে আমার কষ্ট কত, বুঝিয়ে দিস্ গানের ফাঁকে।

বৃষ্টি আমি সে দেশ যাব, রিম-ঝিম-ঝিম গানেরসুরে

চল না বৃষ্টি চল না নিয়ে, সেই দেশে সেই অচিনপুরে...



আশ্চর্য

প্রতিটা মানুষ খুব ভালবাসা চায়

ভালবাসাকে বুকে জড়িয়ে, আগলে রেখে

ভালবাসার গভীর জলে অবগাহন করতে

                      চায় সকলেই।

সকলেই চায় ভালবাসাকে ধরে রাখতে

                    ভালবাসা মেখে পথ চলতে।

সকলেই বোঝে-

পৃথিবীতে আমরণ প্রেম আর ভালবাসা ছাড়া

                    আর কিছু নেই।

তবু মানুষ কেন ভালবাসতেই শিখল না ?

তবুও মানুষ কেন সবচেয়ে কম মূল্য দিল ভালবাসাকে ?

এই দুনিয়ার এটাই সবচেয়ে বড় আশ্চর্য...




একলা আমি

সেই নদীটার কাছে আমি যেই গিয়েছি

সে তো শুধু চুপটি করে শুনল কথা

সেই পাহাড়ের কাছে আমি যেই গিয়েছি

তার তো তখন বুকের ভিতর নিরবতা ।

এই আমিতো এরও আগে কয়েকশ' বার

এদের কাছে এসেছিলাম তোমায় নিয়ে

তখন তাদের সবার কত প্রগলভতা

খিলখিলিয়ে হাসত শুধু সমস্ত দিন।

এখন তুমি যেই গিয়েছ আমায় ছেড়ে

এদের সবার গোমড়া মুখে কুলুপ আঁটা।

তোমায় ডেকে দিলাম চিঠি হাওয়ার গায়ে

তোমায় ডেকে দিলাম চিঠি ঘুড়ির বুকে পাখির ডানায়...

সেই পাখিটা উধাও হল,স্তব্ধ হল বাউল বাতাস

সেই ঘুড়িটা গোঁত্তা খেয়ে পড়ল খসে মাঠের পাশে

ক্যালেন্ডারের দিনগুলো সব থমকে আছে মুখ বেঁকিয়ে

আকাশ জুড়ে অন্ধকারে একলা আমি... একলা আমি…



আঁকিবুঁকি

 আঁকিবুঁকি


- সুদীপ্ত বিশ্বাস


শালুক ফোটা বিল এঁকেছি

পাশে কাশের বন

বাগান ভরা গোলাপ দেখে

নাও ভরিয়ে মন।


মাটির উঠোন, ধানের গোলা?

হ্যাঁ , এঁকেছি তাও

ছোট্ট একটা নদীর বাঁকে

ভাসিয়ে দিলাম নাও।


রং তুলিতে গাছ এঁকেছি

গাছে সবুজ পাতা

উথালপাথাল সাগর এঁকে

ফেলছি ভরে খাতা।


আলোর খোঁজে সূর্য এঁকে

গাছে দিলাম পাখি

বন্ধু তোমার লাগবে ভাল

তাই তো এঁকে রাখি।


নীল আকাশে মেঘের পাশে

উড়ছে দেখ ঘুড়ি

ঘুড়ির বুকে স্বপ্ন অনেক

মন গিয়েছে চুরি।


মেঘের পাশে চাঁদ এঁকেছি

চাঁদটা ভীষণ প্রিয়

ইচ্ছে হলেই বন্ধু তুমি

এই ছবিটা নিও।


কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যপূর্ণ পত্রিকা   "সন্দেশ"  এর পাতায়,মে- জুলাই,২০১৭ সালে।

হ্যাভ-নট

 হ্যাভ-নট

- সুদীপ্ত বিশ্বাস



তোমরা যাবে নাইট ক্লাবে পরবে ফাটা জিন্স

আমার ছেলে রিক্সা পুলার তোমার ছেলে প্রিন্স

তোমরা হলে ধূর্ত শেয়াল আমরা হলাম ফেউ

তোমরা যাবে ডিপ-সী ট্যুরে আমরা গুনি ঢেউ।

তোমরা কর পেপার ওয়ার্ক, আমরা করি কাজ

পুড়ছি রোদে ভিজছি জলে, পড়ছে মাথায় বাজ।

তোমরা চাপ এ. সি. গাড়ি আমরা ধরি ট্রেন

আসতে যেতে চেপ্টে চিড়ে হস্তে হেরিকেন ।

তোমারা হলে রাঘব বোয়াল তোমরা বানাও জোট

আমরা মশাই খেটেই মরি দিই তোমাদের ভোট ।

তোমরা পর হিরের চুড়ি আমরা বানাই ঘট

বাড়ছে তোমার টাকার পাহাড় আমরা তো হ্যাভ-নট।

    


_________

নেতা কাহিনী



 নেতা কাহিনী

রাস্তা হবে, চাকরি হবে, লোহা হবে সোনা

ভোটের মুখে রাস্তাঘাটে নেতার আনাগোনা।

গুন্ডা-ডাকাত,অ্যান্টি-সোশ্যাল ওরাই বিধান দাতা!

ভয় দেখিয়ে ছাপ্পা মেরে ভরায় ভোটের পাতা।

বুজরুকি আর ভণ্ডামিতে এমনি করেই চলছে

মঞ্চ গড়ে দারুণ তোড়ে মিথ্যে বুলি বলছে।

মাকাল ফলের উপর দেখে ভিতর চেনা যায় না

নেতারা কেউ মানুষ তো নয়,শেয়াল-শুয়োর-হায়না।

সততা আর মানবিকতার মূল্য এখন ঘণ্টা

চারিদিকের ব্যপার দেখে যায় বিষিয়ে মনটা।

স্বাস্থ্য দেব,শিক্ষা দেব বলে শুধু ভোলায়

লোভ দেখিয়ে লাভের গুড়টা ভরে নিজের ঝোলায়।

ভোটের পরে ঘটা করে নেতা বসেন গদিতে

আমজনতা ভাসতে থাকে চোখের জলের নদীতে...





দু:খ


 দু:খ


ওগো দু:খ, তোমার জন্য দু:খ হচ্ছে খুব,

তুমিই ছিলে বন্ধু সখা, শত্রু ছিল সুখ।

মরলে আমি তখন তুমি কোথায় যাবে বলো?

দু:খ, তোমার দু:খে আমার দু'চোখ ছলোছলো।


- সুদীপ্ত বিশ্বাস

অভিলাষ


 অভিলাষ

-

তুমি যখন নদী হলে

আমার চোখে আলো

সাঁতরে ভাঙি উথালপাথাল ঢেউ

অনভ্যস্ত গহীন গাঙে

আনাড়ি এই মাঝি

তুমিই জানো, আর কি জানে কেউ?

ঠিক সে সময় ঝাপুরঝুপুর

বৃষ্টি যদি নামে

আকাশ জুড়ে গলতে থাকে মেঘ

সুখ সাঁতারে শ্রান্ত আমি

ঘুমিয়ে যদি পড়ি

জানবে আমার কেটেছে উদ্বেগ।

ঘুম ঘুম ঘুম ঘুমের দেশে

স্বপ্নমাখা চোখে

দু'হাত দিয়ে জাপটে ধরি নদী

বাঁচতে রাজি অযুত বছর

আলোকবর্ষ পারে

ভালবাসা, তোমায় পাই গো যদি!

সহজ তুমি সহজ হয়েই

থেক আমার পাশে

গ্রীষ্ম দিনে,দারুণ মরুঝড়ে

বুকের পাশে নরম ওমের

পালক হয়ে থেক

শীতের রাতে বরফ যদি পড়ে।

আজকাল


 আজকাল


বিপদেরা চুপচাপ ওত পেতে থাকে,

নদীর প্রতিটি বাঁকে-বাঁকে।

সাবধান! সাবধান মাঝি

শ্বাপদের চেয়ে হিংস্র মানুষের কারসাজি।


আলো নেই,

চারিদিকে জমেছে আঁধার চাপচাপ

মানুষকে ভালবাসা ভুল নয়, পাপ।


-সুদীপ্ত বিশ্বাস

খড়কুটো




 খড়কুটো

তোমাকে বুঝবার বুদ্ধি বিধাতা দেননি কাউকে!

কখনও তুমি লাস্যময়ী উর্বশী,

কখনও তুমি মহিষমর্দিনী দুর্গা,

কখনও বা কাল্যানরূপী লক্ষ্মী।

যখন তুমি দখিন বাতাস হয়ে পাশে আসো-

তোমার মিষ্টি স্পর্শে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

যখন তুমি ডানায় ডানায় পাশাপাশি উড়ে চল-

পথশ্রমের কোনও ক্লান্তিই থাকে না।

যখন তুমি হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাও-

আমি আকাশ ভরা তারার মাঝে আমার তারা খুঁজি!

যখন তুমি নিজেকে উন্মোচিত কর-

তোমার অপার তরঙ্গ

আর অসীম গভীরতায় ভাসতে ভাসতে

আমার মনে হয়,

প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে আমি খড়কুটো।



মানুষ


 মানুষ

যত বেশি মন্দির বানাবে

মানুষ তত বেশি হিন্দু হয়ে উঠবে।


যত বেশি মসজিদ বানাবে

মানুষ তত বেশি মুসলমান হয়ে উঠবে।


যত বেশি গীর্জা বানাবে

মানুষ তত বেশি খ্রিষ্টান হয়ে উঠবে।


মানুষ যত বেশি হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিষ্টান হয়ে উঠবে

মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর তত বেড়ে উঠবে।


হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান না হয়ে মানুষ,

সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক।


মানুষের বিপদে মানুষ 

কাকেদের মতই দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ুক।

পিঁপড়েদের মতই শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে শিখুক।

মা আরশোলার মতই মানুষের মাও শিখুক

অন্যের বাচ্চাকে নিজের শিশুর মত ভালবাসতে।      


হাসপাতাল, টয়লেট বা রক্তের মত

মানুষের কোনও জাত হয় না,ধর্ম হয় না,বর্ণ হয় না।

মানুষ শব্দের অর্থ হোক ভালবাসা।

মানুষ ভালবাসতে শিখুক...


~সুদীপ্ত বিশ্বাস

২০২০


 ২০২০


আমাজনের সেইসব মৃত গাছেরা বল্লম হয়ে ছুটে আসছে 


মৃত পশুদের কঙ্কাল থেকে বার হচ্ছে কাঁটা বিষ 


দু'ধারে সারি সারি বন্ধ দোকান

যত্রতত্র মৃত্যুর শীতল ছোবল

   

সব নৌকারা থেমে আছে


মনখারাপের পাতার ওড়াউড়ি

চুনের চেয়েও সাদা বিষন্নতা 


রাত্রে পুলিশ জ্বালিয়ে দিচ্ছে শব

পরিজনেরা আসেনি সমাধিতে


জীবন এত কঠিন হবে ভাবিনি

অদৃশ্য পেঁচারা উড়ছে

গোটা মানবজাতি ভয়ে কুঁকড়ে ঢুকেছে জেলখানায় 


বিষন্ন নীলাভ মানুষ হাত-পা ছুঁড়ছে

বাতাসে অক্সিজেন নেই


~ সুদীপ্ত বিশ্বাস

মহাজাগতিক যাযাবর


 মহাজাগতিক যাযাবর ( Galactic Nomads )


আলোকবর্ষ পেরিয়ে উড়ে চলেছি 

আলোর চেয়েও জোরে


অনেক দূরে পড়ে রয়েছে 

ছোট্ট পৃথিবী আর বিবাদমান ধর্মগ্রন্থগুলো


পৃথিবীর সব ছেঁদো আইনের বই থেকে

খসে পড়ছে এক একটা পাতা


জাতপাত ভ্যানিস হয়ে গিয়েছে

সাদা কালো বলে আর কিছু নেই


সময়কে পাত্তা দিচ্ছি না

মুখ ভেংচে এলাম গ্রাভিটিকে


সামনে একটা রেড জায়েন্ট তারা

জিরিয়ে নিচ্ছি হীরের তৈরি একটি প্রাচীন গ্রহে


হঠাৎ মনে পড়ল মাটির পৃথিবীর স্মৃতি  

সবুজ গ্রামের মত তোমার নরম মুখ

টিনের চালে সেই রাতভোর বৃষ্টি


~ সুদীপ্ত বিশ্বাস

কবির প্রত্যাবর্তন

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ঃ🌷🌷



কবির প্রত্যাবর্তন - সুদীপ্ত বিশ্বাস


জীবনানন্দ কবিতার কারিগর

এই বাংলার ধানসিড়িটির তীরে

হয়ত বা হাঁস, নয়ত অন্য রূপে

বাংলার কবি ঠিক আসবেন ফিরে।


যেখানে সবুজ, যেখানে কাঁঠাল-বট

জারুল-হিজল, চিল-শালিখের ভিড়

কুয়াশার বুকে একদিন তিনি ঠিক

ফিরে আসবেন ধানসিঁড়িটির তীর ।


ঘন কুয়াশায় হাজার বছর হেঁটে

কাঁঠাল ছায়ায় মাঠ-ঘাট ভালবেসে

নীলাভ আকাশে সজিনার ফুল নিয়ে

ফিরে আসবেন কবিতার এই দেশে।


মাঝরাত্তিরে যখন ঝরবে ধান

চড়ুই যখন কাঁঠালি চাঁপার নীড়ে

সোঁদা সোঁদা জলে শিশির গন্ধ মাখা

কবি ফিরবেন ধানসিঁড়িটির তীরে।


গুগলি, শামুক মলিন শ্যাওলা মাখা

গ্রাম বাংলার অনামি পুকুরপাড়,

মাঠের ইঁদুর, ফণীমনসার ঝোপ

উপাদান হবে তার সব কবিতার।


মধুকর ডিঙা যাবে চম্পার কাছে

ভোরের দোয়েল আবার শোনাবে গান

অক্ষর দিয়ে কবি আঁকবেন ছবি

মায়াবী ছন্দ, একটানা যার তান।


রূপসার জলে হয়তো কিশোর হয়ে

শাদা ছেঁড়া পালে ডিঙি তিনি বইবেন

হয়ত আবার আসবে শান্তি নিয়ে

নাটোরের মেয়ে সেই বনলতা সেন...

আমার দুর্গা



 আমার দুর্গা

সুদীপ্ত বিশ্বাস


সব মেয়েতেই দুর্গা দেখি, সব মেয়েরাই মা

মাটির পুতুল দুর্গা তোমার, আমার দুর্গা না।


আমার দুর্গা সঙ সাজে না প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে

রক্তে মাংসে দুর্গা আমার ট্রামে-বাসে-রেলে।


আমার দুর্গা চারদিন নয়, সারা বছর খাটে

কুটনো কাটে, বাসন মাজে, বাজার করে হাটে।


আমার দুর্গা গৃহবধূ, মানুষ করে ছেলে

আমার দুর্গা বিমানবালা, উড়ছে পাখা মেলে।


আমার দুর্গা রেপ হয়েছে, কাঁদছে বিচার চেয়ে

গোটা সমাজ উল্টে তাকেই বলছে 'নষ্টা মেয়ে'।


আমার দুর্গা শরীর দিয়ে সমাজটা ঠিক রাখে

তবুও দেখ সবাই তাদের বেশ্যা বলে ডাকে!


আমার দুর্গা মজুর-কুলি, আমার দুর্গা মাঠে

আমার দুর্গা পেটের জ্বালায় ভিন দেশেতে খাটে।


আমার দুর্গা ফেরার পথে পায়নি বাস বা ট্রেন

হঠাৎ তাকে ডাক দিয়েছে মৃত্যুর সাইরেন।


আমার দুর্গা কাজ হারিয়ে পায়নি কিছু খেতে

চাইছে খাবার দুর্গা আমার রাস্তায় হাত পেতে।


সব মেয়েতেই দুর্গা দেখি, সব মেয়েরাই মা

মাটির পুতুল দুর্গা তোমার, আমার দুর্গা না।

মেঘের মেয়ে




মেঘের মেয়ে ☁  সুদীপ্ত বিশ্বাস

সেদিন যখন বিকেলবেলা ফিরছি আমি বাড়ি
মেঘের মেয়ের সঙ্গে আমার ভাব জমল ভারি!
লুকোচুরির কায়দা-কানুন সবই দিল বলে,
'আসব আবার', কথা দিয়েই হঠাৎ গেল চলে!
সেই থেকে সেই মেঘের মেয়ে বেড়াই আমি খুঁজে
তাকেই খুঁজি দিনের আলোয়, রাত্তিরে চোখ বুজে।
নদীর কাছে যেতেই নদী বলল আমায় ডেকে,
মেঘের মেয়ে দেখতে কেমন? দেখাও ছবি এঁকে।
ঝর্ণা বলে, 'তা তো জানি, কিন্তু ব্যস্ত আজ
যেতে হবে অনেক দূরে, আমার  নানান কাজ।'
ইশারাতে পাহাড় বলে, তার তো সবই জানা,
কিন্তু কিছু করার তো নেই, কথাই বলতে মানা।
চাঁদের কাছে যেতেই চাঁদের হাজার অজুহাত,
দিনের বেলা ঘুমান বাবু, ব্যস্ত সারারাত।
কী যে করি, কোথায় যে যাই!
কোথায় গেলে মেঘ মেয়ে পাই?
একা একাই থাকি বসে, মুখটি করে চুন
আমার এত দুঃখ দেখে বাতাস হেসেই খুন।
বাতাস বলে, 'মেঘের মেয়ের পায়ের তলায় সরষে
এই খেয়ালে একটু থামে আবার চলে জোরসে।
যখন তখন ইচ্ছে মতো বদলে ফেলে রূপ
ইচ্ছে হলেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে টাপুর-টুপ।
ইচ্ছে হলেই বাষ্প হয়ে আমার ডানায় ভাসে
চাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইচ্ছে মতো হাসে।
মেঘের মেয়ে রাগলে পরে তৈরি হয় ছায়া
মেঘের মেয়ের সব কিছু তাই মিথ্যে এবং মায়া।'

মিঠির চিঠি

 মিঠির চিঠি - সুদীপ্ত বিশ্বাস




ছোট্ট মেয়ে মিঠি

এই তো সেদিন

মেঘের ডানায় লিখল সে এক চিঠি-

'বড্ড একা আমি!

তোমরা কি কেউ বন্ধু হবে, আমায় দেবে হামি?'

একলা ছিল গাছ

মিঠির চিঠি পেয়েই সে তো করল শুরু নাচ।

ছোট্ট নদীর ধারে

মাছেরা সব মিঠির চিঠি পড়ল চুপিসারে

উঠলো নেচে খুব

বন্ধু হয়ে স্রোতের টানে আবার দিল ডুব।

চলল চিঠি ভেসে

গাছ-পাখিরা বন্ধু পাতায় মিঠির কাছে এসে।

পাহাড় ছিল একা

মিঠির চিঠি পেয়েই পাহাড় করতে চাইল দেখা।

চলল চিঠি চাঁদে

চাঁদের সবাই চিঠি পেয়ে আটখানা আহ্লাদে!

বলল সবাই, 'মিঠি!

আমরা তোমার বন্ধু হব,আজ পেয়েছি চিঠি।'

জংলী রাত


 জংলী রাত


ব্যাঙ চলেছে ব্যাংককে আর

চিল চলেছে চায়নাতে

রাত দুপুরে গান ধরেছে

হাসনাবাদের হায়নাতে।


মৎস্য বলে, ‘বৎস শোনো,

চিংড়ি কোনও মাছই না।’

নেংটি বলে, ‘মাউস রে তোর

রঙ্গ দেখে বাঁচি না!’


হাঁড়ি নিয়ে হাঁড়িচাচা

যেই না গেল বাজারে

হোগলডুরির হুক্কা শেয়াল

উঠল ডেকে হাজারে।


ঘোঁত-ঘোঁতিয়ে বলল ঘোঁতু,

'আঁমায় কিঁন্তু ঘাঁটাস না

রাঁত দুঁপুরে ঘুঁমের সঁময়

চেঁচিয়ে গঁলা ফাঁটাস না।'


কঙ্গো থেকে কুমীর এল,

সোঁদরবনে সাঁতরে!

বাঘ বাবাজী উঠল হেঁকে,

'আমরা রাজার জাত রে।'


চাঁদনী রাতে চালতা গাছে

পেত্নি বাজায় করতাল

হেঁড়ে গলায় হাকিম হাঁকে,

'কালকে হবে হরতাল।'


এমন সময় তেঁতুল গাছে

ভূতের রাজা মামদো

রাত দুপুরে বায়না ধরে,

‘পেত্নি, মুঝে হাম দো!’


পেত্নি বলে, ‘মামদো রে তুই

ঘুমটা দিলি চটকে,

মটাশ করে এইবার তোর

ঘাড়টা দেব মটকে।’


-সুদীপ্ত বিশ্বাস

ব্যাঙের সর্দি


 ব্যাঙের সর্দি - সুদীপ্ত বিশ্বাস

🐸🐸🐸🐸🐸🐸🐸🐸🐸🐸🐸🐸🐸🐸


ব্যাংককে পা দিয়েই ব্যাঙের লাগল ভীষণ সর্দি

দেশবিদেশে খবর গেল, এল ডাক্তার-বদ্যি।

কী হয়! কী হয়! ব্যাঙ মহাশয় অনেক বড়লোক

বেঘোরে প্রাণ গেল বলেই করতে থাকেন শোক।

সেই আধুলি এত্ত দিনে সুদ আসলে বেড়ে

টাকার পাহাড় যায় বা বুঝি এভারেস্টকে ছেড়ে!

মস্ত মানুষ ব্যাঙ মহাশয় দেশ ভ্রমণে এসে

নাকেরজলে চোখেরজলে গেলেন বুঝি ফেঁসে।

দেশের বাড়ি খবর গেল ব্যাঙের অন্তঃপুরে

ব্যাঙ বৌ তো খবর শুনেই কান্না দিল জুড়ে।

ডাক্তারেরা হাজির হল ফেলে হাজার কাজ

এল অনেক এম ডি-এম এস, অনেক কবিরাজ।

গুগল ঘেঁটে অনেক খুঁজে সব ডাক্তার-বদ্যি

পায়না খুঁজে সারবে কীসে হলে ব্যাঙের সর্দি।

মানুষ দিবস

মানুষ দিবস


পুরুষ-নারী দুটোই সমান বদমাশ আর বিচ্ছু

সঠিক ভাবে দেখতে গেলে ফারাকও নেই কিচ্ছু।


লিঙ্গ দিয়ে মানুষ বিচার করলে সেটা মিথ্যে

হারলে দুটোই গুমরে কাঁদে, দুটোই তো চায় জিততে। 


দুটোই কালো, দুটোই সাদা, দুটোই ভীষণ শক্ত

কাটলে পরে দেখতে পাবে লাল দুটোরই রক্ত।


দুটোই সমান চোর বা ডাকাত, দুটোই সমান খুনিও

গান- কবিতা দুটোই লেখে, দুটোই সমান গুনীও!


নারীদিবস-পুরুষদিবস দাও না এসব উঠিয়ে

তার চে' এস 'মানুষ দিবস' পালন করি চুটিয়ে।